Thursday, May 5, 2016

কার্ল মার্ক্স বিষয়ে দু একটি কথা

ভারতবর্ষের ইতিহাসে ১৮৫৭ সালে সংঘটিত বৃটিশ বিরোধী ভারতীয় সিপাহী ও কৃষক জনতার বিপ্লবী যুদ্ধ এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মহামতি কার্ল মার্কস এই মহান বিদ্রোহকে “ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ” বলে আখ্যায়িত করেছেন। “ব্রিটিশ শাসক শ্রেণিরা অভ্যূত্থানকে কেবল সিপাহীবিদ্রোহ রূপে দেখাতে চায় তার সাথে যে ভারতীয় জনগণের ব্যাপক অংশ জড়িত তা লুকাতে চায় তারা।” (প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ: কার্ল মার্কস- ফ্রেডারিক এঙ্গেলস পৃষ্ঠা ১০)
কার্ল মার্ক্স

১৮১৮ সালের ৫ই মে তৎকালীন প্রাশিয়ার ত্রিভস (ত্রিয়ের) শহরেকার্ল মার্ক্স জন্মগ্রহণ করেন। মার্কসরা ছিলেন সমৃদ্ধশালী এবং সংস্কৃতিবান। তাঁর বাবা হার্শেল মার্ক্স পেশায় ছিলেন একজন অ্যাডভোকেট। শুরুতে ইহুদি ধর্মাবলম্বী হলেও, বিভিন্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক কারণে তিনি সন্তান জন্মাবার আগেই প্রটেস্টান্ট (খ্রিষ্ট) ধর্মে দীক্ষিত হন। ছোট থেকেই কার্ল মার্ক্স ভালো ছাত্র ছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন স্বভাব কবি। প্রেমিকা জেনি ভন ভেস্তফালেন-কে নিয়ে লেখা প্রেমের কবিতাগুলো  সে সবের সাক্ষ্য বহন করে তাছাড়া তিনি "স্করপিয়ন আন্ড ফেলিক্স  Scorpion and Felix  নামক একটি উপন্যাস ও Oulanem নাটক  লেখেন।
কার্ল মার্ক্স ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। বাল্যপাঠ শেষে Trier Gymnasium এ ভর্তি হন, ১৭ বছর বয়সে সেখান থেকে স্নাতক হন। এরপর University of Bonn-এ আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার ইচ্ছা ছিল সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়া, কিন্তু তার বাবা মনে করতেন কার্ল স্কলার হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে না। কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবা তাকে বার্লিনের Humboldt-Universität এ বদলি করিয়ে দেন। সে সময় মার্ক্স জীবন নিয়ে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন, তার লেখার ভাষা ছিল বাবার কাছ থেকে পাওয়া ধর্মতাত্ত্বিক তথা অতিবর্তী ঈশ্বরবাদের ভাষা। এ সময়ই তরুন হেগেলিয়ান Young Hegelians দের  নাস্তিকতাবাদ গ্রহণ করেন। ১৮৪১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল "The Difference Between the Democritean and Epicurean Philosophy of Nature" (প্রকৃতি সম্বন্ধে দেমোক্রিতোসীয় ও এপিকুরোসীয় দর্শনের মধ্যে পার্থক্য)। উল্লেখ্য, পিএইচডি অভিসন্দর্ভ তিনি বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে জেনা বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দেন। কারণ তরুণ হেগেলিয়ান র‌্যাডিকেল হওয়ার কারণে বার্লিনে তার ভাবমূর্তি ভাল ছিল না।
হেগেল

ফয়েরবাখ
বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ভাগ ছিল। তরুণ হেগেলিয়ান, দার্শনিক ছাত্র এবং লুদউইগ ফয়েরবাখ Ludwig Feuerbach  ব্রুনো বাউয়ের Bruno Bauer,-কে কেন্দ্র করে গঠিত সাংবাদিক সমাজ ছিল বামপন্থী। আর শিক্ষক সমাজ ছিল জি ডব্লিউ এফ হেগেল G. W. F. Hegel এই দুটি ভাগ ছিল পরস্পরবিরোধী। হেগেলের অধিবিদ্যাগত অনুমিতিগুলোর সমালোচনা করলেও বামপন্থীরা প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ও রাজনীতির কঠোর সমালোচনার জন্য হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিই অনুসরণ করতো। 
হেগেল সব কিছু পর্যবেক্ষন করে যেটা শেষমেশ দাঁড় করালেন তা হল, বস্তু হচ্ছে ‘absolute idea’ এর দ্বান্দ্বিক প্রকাশ। তিনি যেটা ধরে নিয়েছেন তা হচ্ছে আইডিয়া হল ‘অরিজিনাল আইডিয়া’। কিন্তু তার মধ্যে স্ববিরোধী দ্বন্দ্ব আছে, এবং সেই দ্বন্দ্বের ফলেই বাস্তব জগতের সৃষ্টি। তাঁর কথার মানে দাঁড়ায়, বাস্তব জগৎটা হচ্ছে একটা ছবি এবং সেই অর্থে সেটা হল ‘absolute idea’ এর প্রকাশ । অর্থাৎ দুনিয়াতে যা কিছু ঘটছে তা সেই absolute idea এরই বহিঃপ্রকাশ। এই কারনে হেগেলরই কিছু ছাত্র যাদের বলা হত বাম-ঘেঁষা (Left Hegelian), তাঁরা তাঁদের শিক্ষকের ‘অরিজিনাল আইডিয়া’ কে মানতে রাজী হল না। এর মাঝে ফুয়েরবার্খ, মার্ক্স অন্যতম। তাঁরা যেটা বললেন, ভাব থেকে বস্তু সৃষ্ট নয়, বরং ভাবই বস্তু থেকে সৃষ্ট। মন বা আত্মার কোন আলাদা অস্তিত্ব নেই। মানুষের মস্তিষ্কের ক্রিয়ার ফলেই মন বা ভাবের সৃষ্টি। মানুষের মস্তিষ্কেই ঈশ্বরের অবস্থান। ঈশ্বরের আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। তাঁরা বললেন হেগেলের দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সব ঠিকই আছে শুধু তাকে ভাববাদ থেকে মুক্ত করতে হবে। এভাবেই সৃষ্ট দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথা হল সমস্ত বস্তুই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত এবং দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের মধ্যেই সম্পর্কযুক্ত।
কিছু তরুণ হেগেলিয়ান এরিস্টটল-উত্তর দর্শনের সাথে হেগেল-উত্তর দর্শনের সাদৃশ্য তুলে ধরেন। যেমন, ম্যাক্স স্তির্নার তার Der Einzige und sein Eigenthum(১৮৪৪) বইয়ে ফয়ারবাখ ও বাউয়ারের সমালোচনা করেন, বিমূর্ত ধারণাগুলোর দ্ব্যর্থতাবোধক হেত্বাভাস (reification) চর্চার জন্য তাদেরকে ধার্মিক ব্যক্তি বলে আখ্যায়িত করেন। মার্ক্স এই বই পড়ে মুগ্ধ হয়ে ফয়ারবাখের বস্তুবাদ ত্যাগ করেন। এই রূপতাত্ত্বিক বিরতি (epistemological break)   ঐতিহাসিক বস্তুবাদ বিষয়ে তার ধারণার ভিত্তি রচনায় যথেষ্ট সাহায্য করে।
বন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের পাঠ সমাপ্ত করে মার্ক্স যোগ দেন রাইনল্যান্ডের র‍্যাডিকাল যুবকদের দ্বারা পরিচালিত ‘রাইন অঞ্চলের সংবাদপত্র’ (Rheinische Zeitung) নামক পত্রিকায়। ১৮৪২ সালের অক্টোবর মাসে তিনি এর সম্পাদক হন। সম্পাদক হিসাবে যোগ দেয়ার পর থেকেই মার্কস-এর ক্ষুরধার লেখনীর জোড়ে কাগজের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর ফলে সরকার বাহাদুর যারপরনাই বিরক্ত হন। কয়েক মাসের মধ্যেই কাগজের অফিসে তালা পড়ে যায়। এই সময় মার্ক্স অর্থশাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার পাঠ নেয়া শুরু করেন।
কার্ল ও জেনি

 ১৮৪৩ সালের ১৯-এ জুন জেনির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন কার্ল। জেনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যারনের কন্যা। এর পর তাঁরা চলে আসেন পারী শহরে। ১৯৪৩শেই জর্মন সমাজতন্ত্রী Arnold Ruge এর সাথে জর্মন এবং ফরাসী র‍্যাডিকালদের একত্রীকরনের কাজ শুরু করেন এবং সহ সম্পাদক হিসেবে  Deutsch-Französische Jahrbücher (German-French Annals)- এ কাজ নেন।
পারী শহর ১৮৪৩

পারী শহর থেকেই শুরু হয় অপরিসীম দারিদ্র্য ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রশক্তির প্রবল বাধার মুখে দাঁড়িয়ে তাঁদের লড়াই, যা জীবনের শেষ দিন অবধি ছিল তাঁদের নিত্যসঙ্গী। 
মার্ক্স ও এঙ্গেলস

এই সংগ্রামে মার্ক্স এবং জেনির পাশে এসে দাঁড়ান তাঁদের অকৃত্রিম বন্ধু কমরেড ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস Friedrich Engels ২৮শে আগষ্ট ১৯৪৪ তাদের প্রথম সাক্ষাত Café de la Régence তে। এঙ্গেলস তাঁর  The Condition of the Working Class in England বইটি মার্ক্সকে দেখান এবং মার্ক্স  অবিভুত হন। মার্ক্সের পুরনো দোস্ত Bruno Bauer এর দার্শনিক চিন্তাভাবনা'কে সমালোচনা করে তিনি ও এঙ্গেলস রচনা সমাপ্ত করেন যা কিনা পবিত্র পরিবার The Holy Family নামে প্রকাশিত হয় । ১৮৪৫ সালে প্রাশিয়ান সরকারের বদমায়েশির ফলে ্মার্ক্স-কে তাঁর পরিবার-সমেত প্যারিস থেকে নির্বাসিত করা হয়। তাঁরা চলে যান ব্রাসেলস-এ। সেখানে তাঁর মতনই পালিয়ে আসা কিছু সমাজতন্ত্রী  Moses HessKarl Heinzen, and Joseph Weydemeyer ইত্যাদি মানুষের সাথে দেখা হয় পরের দিকে এই গোষ্ঠিকে আরও জোরালো করতে  এঙ্গেলস ও ব্রাসেলসে আসেন।
ইতিমধ্যে তিনি ও এঙ্গেলস  The German Ideology লেখা শুরু করেন যার ফলে  Ludwig FeuerbachBruno BauerMax Stirner প্রমুখের সাথে বিরোধ বৈরিতা শুরু হয়। ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে লেখা এই বইয়ে মার্ক্স ও এঙ্গেলস তাদের দর্শন তুলে ধরেন। খুবই ব্যঙ্গাত্মক ভংগিমায় লেখা এই বই মার্ক্স ও এঙ্গেলসের জীবদ্দশায় প্রকাশ হতে পারেনি, প্রথমদিকের আরো অনেক লেখার মতই এই বইও প্রকাশিত হয় বহু পরে ১৯৩২ সালে David Riazanov দ্বারা মস্কোর Marx-Engels Institute মাধ্যমে।   
কম্যুনিস্ট ইশতিহার প্রথম জর্মন খন্ড


১৮৪৭ সালে মার্ক্স এবং এঙ্গেলস যোগ দেন কম্যুনিস্ট লিগ  Communist League-এ। সেই বছরের নভেম্বর মাসে লিগের দ্বিতীয় সাধারণ সম্মেলনে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে কার্ল মার্ক্স যৌথভাবে একটি কাজের ঘোষনা করেন শ্রমিকশ্রেণীর অমোঘহাতিয়ার যার নাম ‘কম্যুনিস্ট ইস্তিহার’ The Communist Manifesto ২১ ফেব্রুয়ারী ১৮৪৮ এ প্রকাশিত এই রচনায় তাঁরা দেখান যে ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা হচ্ছে অপর এক শ্রেণীকে দমন করার জন্য এক শ্রেণীর হাতে সংগঠিত ক্ষমতা’। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত এই ছোট্ট পুস্তিকা গোটাইউরোপ-এ আলোড়ন তোলে।
১৮৪৮ সালে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াতে বুর্জোয়া বিপ্লব শুরু হলে মার্ক্স-কে বেলজিয়াম থেকে বিতাড়িত করা হয়। সেখান থেকে প্যারিসের বুর্জোয়া বিপ্লবের ঝড় ঝাপটা পেড়িয়ে সপরিবারে মার্ক্স পৌঁছন জার্মানির কোলোন শহরে। সেখানে তিনি ‘রাইন অঞ্চলের নতুন সংবাদপত্র’ Neue Rheinische Zeitung, নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। তবে খুব বেশী দিন নয়। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে আবার তাঁকে বেঁছে নিতে হয় নির্বাসিতের জীবন। মার্কসরা চলে যান পারী'তে, সেখান থেকে আবার নির্বাসিত হয়ে লন্ডন-এ। বাকি জীবনটুকু তাঁদের সেখানেই কাটে।
১৮৬৪ সালে তৈরি হলো শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংঘ। প্রথম আন্তর্জাতিক   নামেই এই সংগঠন প্রসিদ্ধ। ১৮৭১ সালে প্রথম আন্তর্জাতিকের ফরাসি বিপ্লবীরা প্রতিষ্ঠা করেন প্যারিস কম্যুন Paris Commune। কম্যুনার্ডদের হঠকারী সিদ্ধান্তের সাথে মার্ক্স-এঙ্গেলস একমত না হলেও, তাঁরা তাকে স্বীকৃতি জানাতে ভোলেননি। যাইহোক, খুব বেশীদিন টেকেনি এই সংগঠন। ১৮৭২ সালে হেগ সম্মেলনে রুশ নৈরাজ্যবাদী নেতা Mikhail Bakunin এর সাথে মার্ক্স-এর প্রবল বিতর্ক হয় এবং বাকুনিন বিতাড়িত হন। বাকুনিনপন্থীদের হাত থেকে সংগঠনকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিকের কার্যালয় স্থানান্তরিত করা হয় আমেরিকার ন্যুইয়র্ক-এ। ১৮৭৬-এর ফিলাদেলফিয়া সম্মেলনের পর প্রথম আন্তর্জাতিকের পতন ঘটে—শেষ হয় শ্রমিক আন্দোলনের এক বৈচিত্র্যময় অধ্যায়।

মার্ক্সের সমাধি হাইগেট, লন্ডন
১৮৮৩ সালে চরম অর্থ কষ্টের মধ্যে মার্কস শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় তাঁর স্ত্রীর সমাধিস্থলের পাশে, হাইগেট গোরস্থানে।
#এঙ্গেলসর সাথে মিলে মার্কস গভীর ভাবে ধ্রুপদী জার্মান দর্শন, বিলিতি চিরায়ত অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি কল্পাস্বর্গী সমাজবাদের মূল নীতিগুলো অধ্যয়ন করেন এবং গড়ে তোলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক মতবাদ, যা পরবর্তীতে মার্কসবাদ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এর মানে কখনই এমনটা নয় যে এই তিনটে বিশেষ উপাদানের মিশ্রণে মার্কসবাদ তৈরি। মার্কস জানতেন যে এই তিন আদর্শের ভিতরেও অনেক খামতি আছে। তাই তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খ অধ্যয়ন, অনুশীলন এবং বিশ্লেষণ ক’রে একেকটার ইতিবাচক দিকগুলো চিহ্নিত করেন, বিকশিত করেন এবং একটা বিশেষ পর্যায়ে এসে বিকশিত ইতিবাচক দিকগুলোর সংশ্লেষ ঘটিয়ে সৃষ্টি করেন তাঁর মতবাদ। এই মতবাদ বহুমুখী। আমাদের আরো জানার বাকী তবু কিছু আলোচনা রেখে যেতে চাইছি পাঠকেরা মতামত দিলে বাধিত হব।
#জার্মান চিন্তাবিদ হেগেল যেটি দেখিয়েছেন যে প্রকৃতির মাঝে সবসময় একপ্রকার দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের কারনে প্রতিটি বস্তু প্রতি নিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের দিকে তাকালেও মানব জাতির মাঝে একই রকমের দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। হেগেল এবং মার্ক্স দু’জনেই মানব সভ্যতার ইতিহাসকে ভালভাবে পর্যবেক্ষন করেছেন। শুধু পার্থক্য এই যে হেগেল সবকিছুতে ছিলেন ভাববাদী আর মার্ক্স ছিলেন বস্তুবাদী। মার্ক্স এর নিজের ভাষায় তিনি হেগেল এর দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে মস্তিষ্ক (ভাব) থেকে পাঁয়ে (বস্তু) নামালেন, বলা যায় একেবারে উল্টিয়ে দিলেন। হেগেল-এর দ্বাদ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ভাববাদী ভ্রান্তিগুলো মার্কস শুধরে নেন এবং লুডভিগ ফয়েরবাখ-এর বস্তুবাদী ধারনার অসংগতিগুলোকে দূর করেন, এবং এদের সংশ্লেষ ঘটিয়ে সৃষ্টি করেন মার্কসবাদী মতবাদের দার্শনিক বুনিয়াদ—দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ। মার্কসীও দ্বন্দ্বমূলক মতবাদ হ’ল একটা বিশেষ ধরণের বিচারধারা যা বস্তু কণার অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিপরীত গুণের সমন্বয় ও তার পরিমাণের কমবেশি হওয়ার ভিতর দিয়ে বস্তু কণার গতিময়তা, পরিবর্তন ও বিকাশের প্রক্রিয়াকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে অধ্যয়ন করে এবং তার বিপরীত গুণাবলীর ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে নতুন বস্তুতে রূপান্তরের বিষয়টা সামনে আনে। অতএব আমরা বলতে পারি যে দ্বান্দ্বিকতার মূলসূত্র হ’ল— (১) একই বস্তুকণার মধ্যে বিপরীত গুণের সমন্বয়, (২) পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন, (৩) বিপরীত গুণের ঘাতপ্রতিঘাতের ফলে নতুন বস্তুর উৎপত্তি। মার্কসীও বস্তুবাদ শেখায় যে এক মাত্র বস্তুজগতেরই অস্তিত্ব আছে এবং আমাদের চেতনাও বস্তুজাত। তাই মন বা ভাবের অস্তিত্ব বস্তু ছাড়া সম্ভব নয়, এবং এই বস্তু সদাই গতিশীল (এর ফলে বস্তুজাত জ্ঞানও গতিশীল)। পরবর্তীকালে এঙ্গেলস দেখান যে শুধু সমাজ বিজ্ঞানেই নয়, মার্কসীও দ্বন্দ্বমূলক মতবাদ প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।#দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে মার্কস আবিষ্কার করেন ‘মানব ইতিহাসের বিকাশের নিয়ম’। তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন, ‘রাজনীতি, বিজ্ঞান, কলা, ধর্ম ইত্যাদি চর্চা করতে পারার আগে মানুষের প্রাথমিক ভাবে দরকার খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র, বাসস্থান’। অতএব প্রাণধারণের জন্য সকল প্রকার উপাদান উৎপাদন করতে হবে। ‘এই অর্থনৈতিক বিকাশের মাত্রাই হ’ল সেই ভিত্তি যার উপর গড়ে ওঠে সংশ্লিষ্ট জাতির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, আইনের ধ্যানধারণা, শিল্পকলা, এমনকি তাঁদের ধর্মীও ভাবধারা পর্যন্ত…’। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ শিক্ষা দেয় যে, সমাজ জীবনের পরিবর্তন সাধিত হয় উৎপাদনের শক্তির পরিবর্তনের ফলে, এবং এর ফলস্বরূপ উৎপাদনের সম্পর্ক পরিবর্তিত হয়। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো আপনাআপনি ঘটে না। এগুলো ঘটে এক শ্রেণীর সাথে আর এক শ্রেণীর দ্বন্দ্বের কারণে।
#পুঁজিবাদী সমাজের গতিধারা উদঘাটন করেন মার্কস। তিনি দেখান কিভাবে মূল্যতত্ত্বের সাথে উদ্বৃত্ত মূল্যের ব্যপারটা জড়িয়ে থাকে। এডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো যে মূল্যের শ্রমতত্ত্ব আবিষ্কার করেন। মার্কস তাকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান এবং বিকশিত করেন। ‘তিনি দেখান যে পণ্য (পুঁজিবাদী সমাজে পণ্য উৎপাদনই প্রধান। মার্কস-এর ‘পুঁজি’ গ্রন্থও তাই শুরু হয়েছে পণ্যের আলোচনা দিয়েই) উৎপাদনে সামাজিক ভাবে যে আবশ্যক শ্রম-সময়ের ব্যয় হয়েছে, তা দিয়েই তার মূল্যের নির্ধারণ হয়’।
#মার্কসীয় অর্থনীতির সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল উদ্বৃত্ত মূল্য। বুর্জোয়া সমাজে একজন পুঁজিপতি উদ্বৃত্ত আহরণ করে মুনাফার মাধ্যমে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে একজন পুঁজিপতি উৎপাদনের উপকরণের মালিক হয়, এবং তাই একজন শ্রমিক-কে, যে নাকি উৎপাদনের উপকরণ থেকে বিচ্ছিন্ন, তার শ্রমশক্তি সেই পুঁজিপতির কাছে বিক্রি করতে হয় গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট পুঁজিপতি একাধারে হয়ে ওঠে উৎপাদনের উপকরণের মালিক, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের শ্রমশক্তির মালিক, এমনকি উৎপাদিত দ্রব্যেরও মালিক! শ্রম দিবসের একটা অংশের জন্য সেই শ্রমিক মজুরি পায়, আর একটা অংশের জন্য পায় না। এই বিনা মজুরির অংশটাই উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে। 
#শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ
নিজের রাজনৈতিক-সামাজিক অবদানের কথা বলতে গিয়ে ১৮৫৩ সনে মার্কস ভেদমেয়ার-কে লেখেন— ‘বর্তমান সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব এবং তাঁদের মধ্যে লড়াই, এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার নয়। ...নতুন যেটুকু আমি করেছি, তা হচ্ছে, এই প্রমাণ করা যে (১) শ্রেণীগুলোর অস্তিত্ব শুধু উৎপাদনের বিকাশের বিবিধ ঐতিহাসিক স্তরের সাথে জড়িত; (২) শ্রেণীসংগ্রাম থেকে স্বাভাবিক ভাবেই সর্বহারার একনায়কত্ত্ব আসে; (৩) এবং এই একনায়কত্ব সমস্ত শ্রেণীর বিলুপ্তি এবং একটা শ্রেণীহীন সমাজে উত্তরণ ছাড়া কিছু নয়। ...’
শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্বের অর্থ কি? এর অর্থ হ’ল শোষিত শ্রমিকশ্রেণীকে শাসক শ্রেণীতে উন্নীত করা, এবং জনগণের মূল অংশের গণতান্ত্রিক চাহিদাকে সুনিশ্চিত ক’রে উৎপাদনের উপায়সমূহকে সামাজিক সম্পত্তিতে পরিণত করা এবং শ্রেণী ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা।
#‘গোথা কর্মসূচী’-র সমালোচনা ক’রতে গিয়ে মার্কস তুলে ধরেন যে পুঁজিবাদী সমাজের গর্ভ থেকে জন্মলাভ করা কম্যুনিস্ট সমাজে, অর্থাৎসমাজতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ে, বুর্জোয়া সমাজের অবশেষ রয়ে যাবে এবং তাই তা সমাজতন্ত্রের উচ্চ পর্যায়ের অবস্থা থেকে পৃথক হবে। এই নতুন সমাজের প্রাথমিক অবস্থায় একজন মানুষ ব্যক্তিগতভাবে সমাজকে যতটা শ্রম দেবে, তার মর্মে সে একটা প্রমাণপত্র পাবে এবং তা দিয়ে সে সমাজের ভোগ্যবস্তুর ভাঁড়ার থেকে তার শ্রম মূল্যের সমপরিমাণ ভোগ্যবস্তু লাভ করবে। অর্থাৎ সে সমাজকে যতটা দেবে, অন্যরূপে ঠিক ততোটাই ফেরত পাবে। কিন্তু কম্যুনিস্ট ব্যবস্থার উচ্চ পর্যায়ে এই নিয়ম পরিবর্তিত হবে কেননা তখন শ্রম জীবনধারণের উপায়ের বদলে জীবনের প্রাথমিক প্রয়োজন হয়ে দেখা দেবে, শ্রমবিভাগের জাঁতাকল থেকে মানুষ মুক্ত হবে এবং দৈহিক আর মানসিক কাজের পারস্পরিক বৈপরীত্য আর থাকবে না। এই নতুন ব্যবস্থায় প্রত্যেকে তার ক্ষমতা মতো শ্রম দেবে এবং তার প্রয়োজন মতো দ্রব্য পাবে।
#মার্কসবাদ এমনই একটা বিপ্লবী বিশ্ববিক্ষা যা প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত এগিয়ে চলে, বিকশিত হয়। মার্কসবাদ তাই শুধু মার্কস-এই থেমে থাকেনি, বিকশিত হয়েছে লেনিনবাদে, সেখান থেকে মাওসেতুং চিন্তাধারায়। আসলে মার্কসবাদ নিষ্ক্রিয় মানুষের দর্শন নয়, স্বক্রিয় মানুষের বিশ্ববীক্ষা।  প্রতিযোগিতামূলক পুঁজিবাদের স্তর ডিঙিয়ে সাম্রাজ্যবাদী যুগের প্রথম এবং মাঝের স্তর পেরিয়ে আজ আমরা তার শেষ কিনারে দাঁড়িয়ে আছি। অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, কিছু নতুন দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, কিছু পুরনো দ্বন্দ্ব মুছে গেছে; তবু বদলায়নি খেটে খাওয়া জনতার বিপ্লবী কামনা। সময়ের সাথে সাথে তা বেড়েই চলেছে। তাই উৎপীড়কদের একদিন উচ্ছেদ করবেই এইসব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, আর আগের মতোই সেই সংগ্রামের বাতিঘর হবেন এক বৃদ্ধ দার্শনিক, যার নাম কার্ল মার্কস।

মার্ক্সের গ্রন্থাবলী
১৮৪৮-এ প্রকাশিত ‘কম্যুনিস্ট ইস্তাহার’ ছাড়াও মার্কস বহু গুরুত্বপূর্ণ কেতাব রচনা করেছিলেন। ১৮৪৪ সালে মার্কস রচনা করেন ‘অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক খসড়া’। ঐ বছর ব্রুনো বাওয়ার-এর মতামতের সমালোচনা ক’রে তাঁর প্রবন্ধ ‘ইহুদী প্রশ্ন প্রসঙ্গে’ প্রকাশিত হয়। তার পরের বছর (১৮৪৫) তিনি লেখেন ফয়েরবাখ-এর উপর তাঁর বিখ্যাত থিসিস। সেই বছরই এঙ্গেলস-এর সাথে মিলে রচনা করেন ‘পবিত্র পরিবার’ এবং ‘জার্মান মতাদর্শ’ নামে দুটো বই। ১৮৪৭-এ প্রুধোর ‘দরিদ্রের দর্শন’ নামক ইস্তাহারের সমালোচনা ক’রে মার্কস রচনা করেন ‘দর্শনের দারিদ্র’। ঐ একই বছর প্রকাশিত হয় তাঁর ‘মজুরি শ্রম ও পুঁজি’ পুস্তিকা। ১৮৫২-তে মার্কস লেখেন ‘লুই বোনাপার্টের আঠারোই ব্রুমিয়ের’।
৫-এর দশকের শেষ থেকে মার্কস অর্থশাস্ত্র বিষয়ে বিভিন্ন বই ও পুস্তিকা রচনা করেন।১৮৬৩তে Theories of Surplus Value ১৮৬৭-তে প্রকাশিত হয় তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ ‘পুঁজি’(প্রথম খণ্ড) Das Kapital। এখানে মার্কস পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতিষ্ঠানগুলোকেকাটা-ছেঁড়া ক’রে তার শোষণের দিকগুলো উন্মোচিত করেন। তবে মার্কস পুঁজি শেষ ক’রে যেতে পারেননি। মার্কস-এর পাণ্ডুলিপির থেকে বই-এর পরের দুই খণ্ড সম্পাদনা করেন এঙ্গেলস। ১৮৭১ সালে প্যারিস কম্যুন সম্পর্কে মার্কস তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন ‘ফ্রান্স-এ গৃহযুদ্ধ’ বইতে। ১৮৭৫ সালে ল্যাসাল-এর মতাদর্শের আদলে গড়ে ওঠা কর্মসূচির সমালোচনা ক’রে তিনি লেখেন ‘গোথা কর্মসূচির সমালোচনা’।
এছাড়াও মার্কস অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকা এবং প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর চিঠিপত্রের সংকলন এবং গাণিতিক পাণ্ডুলিপিটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষ নিয়েও মার্কস ছিলেন অত্যুৎসাহী। ভারতের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ, ব্রিটিশ শাসনের চরিত্র ইত্যাদি নিয়ে তিনি গভীর ভাবে চর্চা করেন এবং কিছু কালজয়ী নিবন্ধ রচনা করেন। মার্কস এবং এঙ্গেলস-এর যৌথ সংগৃহীত রচনাবলীর সংখ্যা মোট ৫০।

*** সমাজতন্ত্র পেজ, marxists.org, এর কাছে আমরা বাধিত , কিছু উইকিপেডিয়া লিঙ্ক দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বিস্তারিত জানার জন্যে। সকলকে ধন্যবাদ


0 Comments:

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]

<< Home