Saturday, May 14, 2022

মৃণাল সেন সম্পর্কে দুটি বা তিনটি কথা যা আমরা জানি - তমাল বোস

 পাড়ার এক দাদাকে একবার জিজ্ঞেশ করেছিলাম আচ্ছা কাস্তে হাতুড়ি তো জানি, কিন্তু ঐ তারাটার রহস্য কি? তিনি বলেছিলেন ঐ তারার পাঁচটা কোন পাঁচ জন মানুষের জন্য, মার্কস এঙ্গেলস লেনিন স্তালিন আর মাও। ব্যাখ্যা ভুল না ঠিক তার আর খোঁজ করিনি কখনো কারন ব্যাখ্যাটা খুব ভালো লেগেছিল। 
 বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রেও অমন কোনো তারা থাকলে তার পাঁচটা কোনে যে পাঁচজন মানুষ কে আমরা ভাববো তারা হচ্ছেন বারীন সাহা, ঋত্বিক কুমার ঘটক, সত্যজিৎ রায়, নিমাই ঘোষ এবং মৃণাল সেন। নিমাই ঘোষ এবং বারীন সাহা খানিকটা অপ্রচলিত কিন্তু বাকী তিনজন মহীরুহসম এবং তাল ঢ্যাঙ্গা , এদের মধ্যে একমাত্র মৃণাল সেনকেই চাক্ষুষ করার অভিজ্ঞতা করতে পেরেছিলাম একটা নিউজ ম্যাগাজিনের সৌজন্যে।

         নিমাই ঘোষ 

    বারীন সাহা
 
 বেলতলার বাড়ীতে ওনার  জন্মদিনে আমরা গিয়েছিলাম।সেখানে উনি আমাদের বলেন “চলো বড়লোকের ঘরে বসে কথা বলি”- আমরা অবাক, বড়লোকের ঘর কী, না সেটা ওনার শোবার ঘর আর সেখানে একটা এসি লাগানো আছে, নিজের বাড়ীর অন্দরে এভাবে আগে নিয়ে গেছিলেন পরিতোষ সেন।

    পরিতোষ সেন

 যিনি তাঁর বাসার অন্দরে আমাদের সাবলীল আত্মীয়তায় নিয়ে যান তিনি তাঁর কাজের, ভাবনার, মননের অন্দরে ঢোকার বেলায় আমাদের কিন্তু একটু সমস্যায় ফেলেন, একটু বুঝে পা ফেলতে হয়, কারন ফরাসী জঁ লুক গোদারের রাজনৈতিক  সিনেমা কর্তৃপক্ষকে যেভাবে সোজা আঘাত করতে পারে মৃণাল সেন সেভাবে পারেন না, সামাজিক বোঝাপড়ার জায়গা থেকেই, যেমন পাসোলিনি তাঁর “গসপেল আকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু’তে বা বুনুয়েল তাঁর ভিরিদিয়েনায় যেভাবে চার্চকে সরাসরি আক্রমন হানেন সেভাবে  ঋত্বিক কুমার ঘটক সোজা হামলা করতে পারেন না তাকে বহু রুপকের আশ্রয় নিতে হয় আর হয়ে পড়েন জটিল, একই ভাবে মৃণাল সেন’কেও তাঁর ছবিতে হয় জটিল হয়ে যেতে হয়েছে বা পাখী পড়ানোর মতন করে দর্শককে বোঝাতে হয়েছে । যে কারনে তপন সিংহ, তরুন মজুমদার, অজয় কর বা কিয়দংশে সত্যজিৎ রায় বক্স সফল পরিচালক ঠিক তার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে ঋত্বিক-মৃণাল। 

    গসপেল আকর্ডিং টু সেন্ট ম্যাথু ছবির দৃশ্য

    লাস্ট সাপারের অনুকরনে সাজানো ভিরিদিয়েনার সেট।
 
 গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের বিশেষ বন্ধু মৃণাল সেন নিজেকে বলতেন প্রাইভেট মার্ক্সিস্ট। মৃনাল সেন ,ঋত্বিক ঘটক ও সলিল চৌধুরি তিনজন ছিলেন ভীষণ ঘনিষ্ঠ বন্ধু,একেবার হরিহর আত্মা যাকে বলে । চরম দারিদ্রের মধ্যে বসবাস তিনজনেরই । স্বপ্ন দেখতেন সমাজ বদলাবার , আর তার হাতিয়ার হবে চলচ্চিত্র । তিনজনই কম্যুনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখা IPTA এর সদস্য। (মৃণাল পার্টি সদস্য হন নি) দু’ পয়সায় সিগারেট খেতেন, তাও অনেক সময় বাকীতে। ঋত্বিক খেতেন বিড়ি, দু’ পয়সায় তিরিশটা’র প্যাকেট । তাতেও বাকী পড়েছিল- সেদিনের আশি টাকা। খবর পেলেন বোম্বে থেকে পালিয়ে এসেছে এক ছেলে । কলকাতার এক বস্তিতে থাকে তার খাবারও পয়সা নেই। বোম্বের চলচ্চিত্র রাজনৈতিক কারণে তাকে বয়কট করেছে। রাজনীতি সেই তখন থেকেই সেখানে অচ্ছ্যুৎ । তিনিই হচ্ছেন পরবর্তি কালে বিখ্যাত বাংলা নাটকের আলোক সম্পাতকারী তাপস সেন।দু’দিন না খেয়ে মৃণাল সেনের কাছে এলেন "দু’দিন খাইনি । একটা টাকা দিতে পার ?" মৃণালের পকেটে তখন তিনটে টাকা। দিদি ফিলমের বই কিনতে টাকাটা দিয়েছেন। তার থেকেই তাকে খাইয়ে টাকাটা দিলেন ।

প্রচুর পড়াশুনা করতেন তখন থেকেই  সাহিত্য ,সঙ্গীত আর রাজনীতি তো ছিলই ।একদিন ট্রেনে ‘A case of communism’ (বইটার সঠিক নামটা মনে করতে পারছিনা এতদিন পর,তবে এ রকমই কিছু ) হাতে পেয়ে পড়তে পড়তে কেমন করে দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে পড়েন নির্দিষ্ট ষ্টেশন ছেড়ে অন্যপথে বহুদুর চলে গেলেও টের পাননি । এমনিতে পয়সার অভাবে বিনা টিকিটে ভ্রমন করতেন, তো আবার ফিরতি ট্রেনে চড়েন ইতিমধ্যে ৬০ পৃষ্ঠা পড়া হয়ে গেছে । সেদিনই গীতার (পরবর্তিতে তার স্ত্রী গীতা সেন) সাথে প্রথম দেখা হওয়ার কথা যা আজকের ভাষায় ডেটিং-সেই অবস্থায় এক ব্রীজের উপরে দেখা হয়েছিল এবং তার প্রথম হাত ধরার কাঁপুনি এবং তখনই বইটাও ব্রীজের উপর থেকে জলে পড়ে তলিয়ে যায় । সে বই আর পড়া হয়নি।
     গীতা সেন ও মৃণাল সেন

 ঋত্বিক কাবুলীর কাছ থেকে টাকা ধার করেছিলেন সিনেমা করার জন্যে । প্রতি ১০০ টাকা ধার নিলে প্রতি মাসে ১০/- সুদ । কাবুলীদের কিভাবে ফাঁকি দিয়ে চলতে হয় সেটা তার কাছে থেকেই শিখেছেন। আর কাবুলিরাও নাছোড়বান্দা-ঠিক বের করতো খুঁজে। আসল নয়,সুদ ঠিক মত দিতেই হবে । তবু ছবি করার স্বপ্ন । ছবি করার জন্য টাকা দেবার জন্য কাউকে রাজী করানোর জন্য কত পরিকল্পনা, কত প্রোগ্রাম । কিন্তু কখনও কাউকে এমন কোন দাবী বা পরিকল্পনার কথা বলতেন না যাতে তারা না বলে দেয়। সবসময় এমনভাবে বলতেন যেন সরাসরি না বলতে না পারে । একটা আশা যেন থাকে-ওই আশাই বাঁচিয়ে রাখতো । নইলে একবার না বলে দিলে আর থাকে কি।
একজায়গায় তিনি বলছেন “ দুঃখের দিনের সেইসব বন্ধুরা আজ কে কোথায় গেল । ঋত্বিক ,সলিলের সাথে বন্ধুত্বটা কিভাবে ভেঙ্গে গেল। একসময় জীবনে প্রতিষ্ঠা পেলেন, কিন্তু ততদিনে দেখলেন আর সেই বন্ধুত্ব তেমনটি আর নেই। "বন্ধু যদি Contender হয় তবে সেই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মুস্কিল । এই কলকাতা শহরে একসাথে বাস করছি অথচ ঋত্বিকের সাথে যোগাযোগ নেই । ওর মেয়েকে দেখলে চিনতে পারবো না ,ভাবলেও দুঃখ হয়, কিন্তু এক্কেবার সত্যি।”(সেই সমহিতা ঘটকও ও আমাদের মধ্যে আর নেই)

 দেশভাগের আগে ও পরেও - হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার সময় লড়েছেন। গরু খাওয়া তখনই শিখেছেন । কারণ সারারাত জেগে মুসলিম পাড়া পাহাড়া দিতে হয়েছে । খিদেও লাগত প্রচুর অথচ পকেটে পয়সা নেই । তখন সেই পাড়ারই ছোটখাট মুসলিম হোটেলে লোকেরা তাদের খাওয়াত,অল্প পয়সায় গরু ছাড়া আর কি! 
(প্রঙ্গত বলি, প্রবাদপ্রতীম শিল্প নির্দেশক খালেদ চৌধুরীও এই পাড়া পাহারাদারীর কাজ করতেন, তিনি আবার এককাঠি বারা, দিনে হিন্দু পাড়ায় পাজামা পড়ে কালী চৌধুরী নামে আর রাতে মুসলিম পাড়ায় লুঙ্গী পরে খালেদ নামে। অনেকেই হয়তো জানেন যে  বাংলা তথা ভারতীয় মঞ্চশিল্পের এই আশ্চর্য মানুষটির পিতৃদত্ত নাম চিররঞ্জন দত্তচৌধুরী। নাম বদলে নেওয়ার পিছনে রয়েছে এক প্রতিবাদী ইতিহাস। সে গল্প আর একদিন হবে)
                   খালেদ চৌধুরী

 হৃষিকেশ মুখার্জী ছিলেন দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মাইনে পাওয়া লােক। অ্যাসিস্টান্ট এডিটর হিসেবে ৬০ টাকা মাসিক মাইনেতে কাজ করতেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে। দলের বাকীরা, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, তাপস সেন তখন ছবিতে ঢােকার চেষ্টা চালাচ্ছেন আর রাজনীতি করে যাচ্ছেন। 
      রাজ কাপুর ও ঋষিকেশ মুখার্জী

 হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শচীন দেব বর্মণ, সলিল  চৌধুরী ও রাহুল দেব বর্মণ

    যুবা বয়সের তাপস সেন 

    ঋত্বিক ঘটক
 মৃণাল কোনদিনই কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার ছিলেন না, ঋত্বিক পরে মেম্বার হয়েছিলেন, এবং সদস্যপদ হারান'ও সেকথা অন্যত্র। মৃণাল মেম্বার ছিলেন না, পার্টি যখন এক ছিল তখনও না, যখন দুভাগ হল তখনও না। কিন্তু ওনাকে ওঁরা সকলে পার্টি মেম্বারের মতােই দেখতেন। ইংরেজ আমলে এবং কংগ্রেস আমলে যখন পার্টি আণ্ডারগ্রাউণ্ডে তখন উনি আণ্ডারগ্রাউণ্ড ওয়ার্কারের যেরকম কাজ বা দায়িত্ব ছিল সে ধরনের কাজও করেছেন। সেইসময় ওই
দায়িত্ববােধ থেকেই লেনিনের একথায় বিশ্বাস করতেন যে  “that of all the arts the most important for us is the cinema.” জোরের সঙ্গেই বিশ্বাস করতেন।
     ভ্লাদিমির লেনিন

 আসলে ফিল্ম তো একটা vehicle of expression, একটা instrument for social change। এ সম্পর্কে পরে কথা উঠতে পারে ফিল্ম কতখানি সােস্যাল চেঞ্জ করতে পারে, ম্যাজিকের মত কোন কিছু করতে পারে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।
 তো সেই সময়ে কিন্তু ওঁরা গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন ফিল্ম অনেক কিছু করতে পারে। এই তাগিদ থেকেই ওঁরা ফিল্মে ঢোকেন। সেখানে দুটো ব্যাপার মিশে গেল। মৃণালের বক্তবেই আছে " As a social being I need to express myself. I need to convey to others এবং সেইদিক থেকে want to sharemy own opinions with others or I want to provoke a controversy which is also very important। "

      মৃণাল সেন

 মৃণালের মনে হত সেখান থেকে ওঁরা একটা জায়গায় পৌঁছােতে পারেন। কিন্তু বললেই তো আর ছবিতে ঢুকতে পারা না! তখন ওঁরা একটা স্ট্র্যাটেজি ঠিক করলেন। সবাই মিলে ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রির ভেতর একটা ট্রেড ইউনিয়ন করবেন অর্থাৎ চেষ্টা করছিলেন ট্রেড ইউনিয়ন করে যদি ছবির মধ্যে ঢুকতে পারেন। 

    সেকালের নিউ থিয়েটার্স স্টুডিও - Photo courtesy Film Heritage Foundation.
 
 স্টুডিওতে ওয়ার্কাররা অসম্ভব কম টাকা পেত। ধারণা করা যায় না এত কম টাকা পেত সেখানে! অ্যাক্টররা কিংবা নামকরা ডিরেক্টররা যা মাইনে পেতেন, যা খেতেন, যা ট্রিটমেন্ট পেতেন, সাধারণ ওয়ার্কারদের সঙ্গে তার কোন তুলনাই হয় না। তো ওঁরা বিভিন্ন স্টুডিওতে এইসব বিষয় নিয়ে আলােচনা আরম্ভ করলেন, দাবী-দাওয়া পেশ করতে, সংঘবদ্ধ হতে। এভাবেই ভেতরে ঢুকে পড়লেন। অর্থাৎ ওঁদের যা ইচ্ছে ছিল গেট ক্র্যাশ করা তাই।
 দুঃখের বিষয় হল সবাই যখন পায়ের তলায় কিছুটা মাটি খুঁজে পেলেন তখন যে বন্ধুত্ব নিজেদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল তা আস্তে আস্তে কিভাবে যেন ভেঙ্গে গেল। নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ খুবই কম হতে শুরু করল।যে ধরনের আলােচনা করতেন, একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার কথা ছিল সেটা আর হয়ে উঠল না।
    ১৬ এম এম মুভি ক্যামেরা, অ্যারিফ্লেক্স

 ফিল্ম ইণ্ডাস্ট্রিতে ঢােকার আগে হৃষিকেশ মুখার্জী অত্যন্ত প্রাচীনএকটা 16 mm ক্যামেরা নিয়ে ছবি তােলার কথা ভাবতেন। তখন কমিউনিস্ট পার্টি ইললিগ্যাল এবং আন্ডারগ্রাউণ্ডে। ওঁরা খবর পেলেন কাকদ্বীপ লাল এলাকা হয়ে গেছে,সব লাল হয়ে যাচ্ছে। ঠিক করলেব ওখানে16mm ক্যামেরা নিয়ে ছবি করা হবে, জমির লড়াই বলে একটা স্ক্রিপট'ও করে ফেললেন। পরে অবশ্য সমস্যা হল ছবি প্রসেস করানাের ব্যাপারে এবং ছবিটি হয়ে উঠল না। কিন্তু যেটা বলছিলাম যে, ছবি করার তাগিদটা সমাজ পরিবর্তনের দিক থেকে ছিল এবং সেটা বেশ ভালা মাত্রায়ই ছিল।
     মৃণাল সেন, নাসিরুদ্দিন শাহ - খন্ডহর

 তো এভাবেই ছবিতে এসে পড়লেন মৃণাল সেন।
মৃণাল সেনের প্রথম ছবি রাতভোর ১৯৫৫, গ্রামের ছেলে  শহরে আসছে এবং সেখানকার সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে এক মর্মান্তিক মৃত্যুবরন করছে , অতি দুর্বল চিত্রনাট্য, উত্তম কুমার, সাবিত্রী, ছবি বিশ্বাসের মতন অভিনেতা থাকা সত্বেও সে ছবি চলেনি, কিন্তু যদি ছবিটা দেখে থাকেন তাহলে খেয়াল করে দেখবেন যে এই রাত ভোরের গল্পটাই কিন্তু মৃণাল সেন তাঁর পরের প্রায় সব কটি ছবিতেই নানা ভাবে বলতে চেয়েছেন, ঋত্বিকের যেমন বারবার দেশভাগের যন্ত্রনা ফিরে ফিরে এসেছে সেভাবেই মৃণাল সেনের ছবিতেও বার বার ফিরে এসেছে পরের ছবি গুলোতে তিনি যেভাবে ও যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় কথাটা বলতে পেরেছিলেন রাতভোরে হয়তো সেভাবে পারেননি কিন্তু এটা ঠিক হয়েই গেছিল যে তিনি কি বলবেন তাঁর ছবিতে। 
    
জসীমুদ্দিন তার ‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’ করার কথা একবার বলেছিলেন । মৃণাল সেন সেই ভেবে স্ক্রিপ্টও করেছিলেন অনেকটা । '‘৭১ তখনদেশ সবে স্বাধীন, চারদিকে একটা আলগা অবস্থা, আমি বাইরের মানুষ গিয়ে ছবি করব, কে কি ভাববে-ভয় ছিল । ব্যপারটা স্পর্শকাতরও ছিল । সেটা অমূলক না ।পরে শুনলাম অন্য কে একজন করছেন ,তাই আর সেটা হয়নি।”  মৃণালের বক্তব্য হচ্ছে যে “এমন ছবি বানাতে হবে যেন সবাই দেখে-কিন্তু কোন কম্প্রোমাইজ নয় শিল্পের সাথে,নীতির সাথে। ছবি তো শুধু গুটি কতক দর্শকের জন্য ছবি নয়, যত বেশি লোক দেখবে তত বেশি তার সার্থকতা । তবে ওই কখনও আপোষ করে নয় সিনেমা আলাদা কোন শিল্প নয়,বরং বলা যায় এটি সব শিল্পের সমন্বয়।”  

সিনেমা সবচেয়ে পরে এসেছে তাই ওর মধ্যে সব শিল্পের একটা সমন্বয় হয়েছে ,বার্গম্যান একদিকে ছবি করেছেন,অন্যদিকে নাটক । মাঝখানে দেয়াল নয় -একাট অর্গল রেখেছেন । অন্য সব শিল্পকে আত্মস্থ করতে হবে । বাইসাইকেল থিফ’দেখে আদ্রে জিদ চিঠি দিয়েছিলেন তার মধ্য শিল্পসুষমা ও মাধ্যমে সমন্বয় দেখে। আইজেনষ্টাইন নিজেও ছিলেন তেমনি একাধিক শিল্পের অধিকারী-বিশ্বের একনম্বর পরিচালক।  

 আর তাই দেখি মৃণাল সেন তাঁর ছবিতে এনে ফেলেন ফ্রিজ ফ্রেম, জাম্প কাট, ডাইরেক্ট পেইন্টিং নিউজ রিডিং ইত্যাদি বস্তু যেগুলি তৎকালীন বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমায় নতুন জিনিষ। চিত্রগ্রাহক কে কে মহাজন কে ১০ তলা বাড়ীর কার্নিশে তুলে নিজে তাঁর কোমর জাপটে রেখে শ্যুট করিয়েছেন, ঠিক এই জিনিষ গোদার আর রাউল কুতারের ক্ষেত্রে আমরা পাই। বলতে দ্বিধা নেই গোদারের আগেই বা সমসময়েই এইসব নতুন জিনিষ দিয়ে বেশ ভালোভাবে প্রভাবিত করেছিলেন মৃণাল সেন। তাই পশ্চিমের গোদার আর আমাদের মৃণালের মুখে প্রায় একই কথা “ছবি বানাতে অনেক পয়সা লাগে বলে যারা ভয় পাইয়ে দেয়, তারা মিথ্যে বলে ।পয়সা লাগে যদি লাগাতে চাও। কম পয়সায়ও ছবি বানান যায়- এবং তা ভালো ছবিও” ।
     মৃণাল সেন ও কে কে মহাজন

    জঁ লুক গোদার ও রাউল কুতার

 চার্লি চ্যাপলিন কে নিয়ে তাঁর ছিল বিশেষ অনুরাগ, তাঁর তৈরী আকাশ কুসুম ছবিতে দেখবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের লিপে গান আছে “তোরা যে যা বলিস ভাই আমার সোনার হরিণ চাই” তাঁর মনে পড়ে যায় গোল্ডরাশ ছবির কথা, ১৯৫৩ বা ৫৪ তে চ্যাপলিন কে নিয়ে তিনি লেখেন একটি বই যার নাম ছিল 'এই যে আমি চার্লি চ্যাপলিন' পরে সে নাম পালটে হয় শুধু  'চার্লি চ্যাপলিন' কিছু বছর আগে নিউ এজ থেকে সে বই আবার বেড়িয়েছে এবং সাথে আরো কিছু লেখা যুক্ত হয়ে যার নাম হয়েছে “চ্যাপলিন নামা’’। 
 মার্কেজ সিনেমা বানাতে বলেছিলেন মৃণাল সেনকে। হ্যাঁ লাতিন আমেরিকার অবিসংবাদিত সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। তিনি চাইতেন না তার লেখা নিয়ে কেউ ছবি করুক। তবে ভারতের খ্যাতনামা চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনকে তিনি তার ‘অটম অব দ্য প্যার্টিয়ার্ক’ নিয়ে ছবি বানানোর অনুরোধ করেছিলেন। এ জন্য তিনি কোনো অর্থও নেবেন না বলেছিলেন। কিন্তু মৃণাল সেন এ ব্যাপারে তার অপারগতার কথা সরাসরি তাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।

 এ ব্যাপারে মৃণাল সেনের বক্তব্য ছিল, '‘আসলে তিনি (মার্কেজ) একটা ভারতীয় কানেকশন খুঁজছিলেন। কিন্তু আমার পক্ষে ওই গল্প নিয়ে ছবি বানানো সম্ভব ছিল না। ভারতীয় বাড়ির ছবি থেকে গল্পটি ওর মাথায় এলেও পুরোটাই ভীষণ রকম লাতিন।’' মার্কেজ জানিয়েছিলেন, ছোটদের কোনো একটা বইতে তিনি একটা ভারতীয় বাড়ির ছবি দেখেছিলেন। সেই ছবিটিকে মাথায় রেখেই লিখেছিলেন গল্পটি।
মৃণাল সেন মার্কেজকে বলেছিলেন, গল্পে সমাজ থেকে শুরু করে আদব-কায়দা সবই লাতিন আমেরিকার আদলে। ফলে সেটিকে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। মার্কেজ কথাটা মেনে নিয়েছিলেন। মার্কেজ নিজেও চাইতেন না তার লেখা নিয়ে কোনো সিনেমা তৈরি হোক। কথাটা তিনি হাভানায় বসে মৃণাল সেনের সঙ্গে এক আড্ডায় বলেছিলেন। মার্কেজ মনে করতেন, ওর গল্পের যা গঠন তা থেকে ছবি করা মুশকিল। গল্পের মূল চরিত্রটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
    গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ও মৃণাল সেন

 মার্কেজের মৃত্যুর পর তার সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা বলতে গিয়ে মৃণাল সেন জানান, ১৯৮২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে মার্কেজও ছিলেন জুরি হিসেবে। সেখানে প্রথম দেখা হলেও সেই আলাপ দ্রুত বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। এর দু-তিন বছর পরে হাভানাতেই মার্কেজের সঙ্গে অনেক আড্ডা হয়েছে। সাহিত্য থেকে কীভাবে ছবি বানানো যায়, তা নিয়েও অনেক আলোচনা করেছিলেন তিনি মার্কেজের সঙ্গে। ওপরের এই আলোচনা থেকেই অনুমান সম্ভব মৃণাল সেন কোন মাপের চলচ্চিত্র নির্মাতা।

এটুকুই থাক আজ, প্রায় ৬০ বছরের চলচ্চিত্র-সংগ্রামের ইতিহাস এত স্বল্প পরিসরে হাজির করা সম্ভব নয়। মৃণাল সেনের কোনো ছবি নিয়েই আমরা আজ কথা বললাম না। শতবর্ষে আমরা চেষ্টা করব সেসব নিয়ে কিছু বলার।

লেখ সূত্র
১- নন্দন প্রেক্ষাগৃহে সিনেসেন্ট্রাল-চিত্রবীক্ষন পত্রিকা আয়োজিত এক সভায় দেওয়া সাক্ষাৎকার pp.9

২- V. I. Lenin, Collected Works (New York: International Publishers, 1934), Vol. XLII, pp. 388-389.

লেখার কোনোও কপিরাইট নেই, লেখকের নাম সহ বা নাম ব্যাতিরেক যে কেহই ইহা অবাণিজ্যিক ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যবহার করিতে পারেন।

Labels:

2 Comments:

At May 14, 2022 at 1:46 PM , Blogger hulg said...

খুব ভালো লেখা।

 
At May 14, 2022 at 11:33 PM , Blogger Tamal Bose said...

ধন্যবাদ

 

Post a Comment

Subscribe to Post Comments [Atom]

<< Home